দেবশ্রী-এক স্বর্গীয় অনুভূতি: পর্ব ১৮: খণ্ড: ২

🔗 Original Chapter Link: https://chotimela.com/jhal-moshla/debosree-ek-shorgio-onubhuti-18-2/

🕰️ Posted on Mon Mar 07 2022 by ✍️ Jupiter10 (মৃত তারার গল্প।) (Profile)

📂 Category:
📖 1530 words / 7 min read
🏷️ Tags:

Parent
মায়ের পেছন পেছন আমিও সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম। মা নিজের রুমে ঢুকে পড়ল আর আমি আমার রুমে গিয়ে পুরনো পোশাক বদলে ব্লু জিন্স এবং সাদা শার্ট পরে নিলাম। এখন শীত কম সেহেতু সোয়েটার পরার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আমি তৈরি হয়ে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে পেছন দিকে এসে দাঁড়ালাম। মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর মাকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। মা হালকা ঘিয়া রঙের একখানা শাড়ি পরে বেরিয়ে এলো।হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে চুপিচুপি বাঁশের গেট খুলে বেরিয়ে গেলো। আমিও মা’কে অনুসরণ করলাম। মোরামের রাস্তা ক্রস করে পাকা ধানের আল দিয়ে হাঁটতে লাগলাম মা ছেলে মিলে। মা শাড়ির কুচি সামলে নিয়ে সযত্নে হাঁটছিল। আমি তাঁকে অনুসরণ করছিলাম। মনে প্রশ্ন উঠছিল, “মা আমাকে কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছে?” কিন্তু তার সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনে মনে শুধু বলছিলাম, “ভাঙা মন যেদিকে যেতে চায় যাক না। তাতে যদি তাঁর মন ভালো হয় তাহলে তাঁকে সেটাই করতে দেওয়া উচিৎ”। ধান মাঠের আল পেরিয়ে ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে বাবলা গাছের ধার বেয়ে মায়ের পেছন পেছন হেঁটেই চলেছি। প্রায় পনেরো মিনিট আমাদের হাঁটা হয়ে গেলো। পা ব্যথা করছিলো আমার। বিরক্তও লাগছিলো। কিন্তু মায়ের মধ্যে কোন ক্লান্তি লক্ষ্য করছিলাম না। একবার ভাবলাম মা কি তাঁর ছেলেবেলার কোন পুরনো ঠিকানায় ফিরে যেতে চাইছে? নাকি অন্য কোথাও? আমি একটা বিরক্তিভাব প্রকট করলাম, “উফ! আর কতক্ষণ লাগবে বলতো? পা ব্যথা করছে আমার”। সামনে তাকিয়ে মা উত্তর দিলো, “ এই তো চলে এসেছি বাবু”। লক্ষ্য করলাম। ধানক্ষেত, ফাঁকা মাঠ অতিক্রম করে এখন ঢালু মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি। কিছু কিছু ধানের মাঠ থেকে ধান কেটে নেওয়া হয়েছে। আর কিছু মাঠে এখনও চাষি মহিলারা ধান কাটছেন। মাকে অনুসরণ করতে করতে একটা নতুন জায়গায় পৌঁছে গেলাম। নদীর ধার। তার চারপাশে সোনাঝুরি গাছ। আমার একটু অবাক লাগল। হঠাৎ মা আমাকে এই খানে কেন নিয়ে এলো। এই ঝোপঝাড়ে ঘেরা নদীর ধারে। কৌতূহল ধরে না রাখতে পেরে তাঁকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “ মা তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে বলতো?” মা আবার আঙুলের ইশারায় আমাকে নদীর ধারের দিকে দেখাল। বিনতিসুলভ আচরণ তাঁর, “বাবু এই নদীর ধার বেয়েই যাওয়া হয়। তুই আমায় নিয়ে চল না রে?” আমি নদীর ধারে তাকালাম। নাহ এখানে তো কোন সুস্পষ্ট রাস্তা নেই যেখান দিয়ে হাঁটা যায়। এতো শুধুই জংলী গাছে ঘেরা। মা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি? বললাম, “কোথায় যেতে চাও বলতো মামণি?” মা বলল, “কঙ্কালীতলা!” আশ্চর্য হলাম, “কঙ্কালীতলা? ওটা আবার কিসের জায়গা মা?” মা বলল, “ওটা এখানকার শ্মশান। তুই আমায় নিয়ে চল বাবু। তোর দাদাই এখন ওখানেই আছেন”। মায়ের করুণ আর্জির মধ্যে তাঁর চোখের কোণায় অশ্রু লক্ষ্য করলাম। অসহায় নিবেদন। আর আমি অপারক। তাঁর সিক্ত চোখ দুটো আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিলো। মায়ের কান্না আমাকে দুর্বল করে তুলছিল। আমাকে নীরব থাকতে দেখে এগিয়ে এসে আমার ডান হাত টেনে ধরল, “নিয়ে চল না আমায়…”। হতভম্ব হয়ে মাকে আশ্বস্ত করি, “থামো মা।থামো। আমি মোবাইলে সার্চ করি। দেখি তোমার কঙ্কালীতলা কোন দিকে অবস্থিত”। আমার কথায় মা খানিক শান্ত হল। আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। মোবাইল বের করে মনে মনে বলতে লাগলাম, “মা আমাকে বেজাই ঠকালো। ভেবেছিলাম এক আর হল এক। মায়ের মন থেকে এখনও দাদাইয়ের শোক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি”। মোবাইল বের দশ মিনিট ধরে গুগুল ম্যাপে কঙ্কালীতলা সার্চ করলাম কিন্তু ইন্টারনেটের পরিষেবা দুর্বল হওয়ার কারণে কোন ফলাফল পেলাম না। বেশ দুবিধায় পড়লাম মনে হল। এই মুহূর্তে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওই দিকে মায়ের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম হচ্ছিলো। সে শুধু বায়না করে যাচ্ছিলো আমাকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য। মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তাঁর দুই কাঁধ চেপে ধরে বললাম, “নিজেকে শক্ত কর মা। দাদাই আর এই দুনিয়ায় নেই। সেখানে গেলে ছাইয়ের অবশিষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না”। মা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। কোপাই নদীর সন্নিকটে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা দুই জন মিলে এই নির্জন এলাকায় দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে ঝোপঝাড়,সোনালি ফুলের গাছ, বাবলা গাছ এবং চোখের সামনে শুকনো নদী। দুই হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছিলাম। মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এই পরিস্থিতিতে হাল আমাকেই ধরতে হল। মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম, “মা দাদাই মারা যাননি…”। আমার কথা শুনে মা চোখ তুলল। বললাম, “হ্যাঁ মা দাদাই মারা যাননি বরং তিনি পঞ্চতত্ত্বে মিশে গেছেন। আর আত্মা নাকি মরে না। সেহেতু তিনি মারা যাননি মা”। মা আমার মুখের দিকে গভীর ভাবে চেয়ে ছিল। হয়তো কিছু ভাবছিল। আমি তাঁর চোখের দিকে চেয়ে বললাম, “হ্যাঁ মা। দাদাই হয়তো অন্য কোন রূপে পরিবর্তিত হয়ে গেছেন। হয়তো এই শীতল বাতাস রূপে আমাদের শরীরকে স্পর্শ করছেন। অথবা দূরের কোন পাখির রূপ ধারণ করে ভিন দেশে উড়ে চলেছেন”। মায়ের গভীর চোখের কালো মণি দুটোর মধ্যে আমার চোখ স্থির হল। মা কাঁদা থামিয়ে দিয়েছে। আমি তাঁর কপালে একখানা চুমু খেলাম। তারপর তাঁর সিক্ত ঠোঁটে আমার ঠোঁট স্পর্শ করালাম। সঙ্গে সঙ্গে মা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আমি তাঁকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। চারিদিক নিস্তব্দ। শুধু হিমেল বাতাস সোঁ সোঁ শব্দ করে আমাদের গায়ে আছড় মারছে আর দূরে পাখি দের কলরব শুনতে পাচ্ছিলাম। মানুষজনের কার্যকলাপের ধ্বনি কানে আসছিলো না। নইলে কলকাতার গাড়ির হর্নের শব্দ এবং মানুষের চেঁচামেচিতে এতক্ষণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম। এই সময় উপভোগ করার মতো। শোক পালন করার জন্য নয়। শীতের রোদের মধ্যেও একটা মাঝারী উত্তাপ অনুভব করছিলাম। মায়ের কপালে তেলচা ঘাম জমেছে। আমি তাঁর কাঁধ জড়িয়ে ধরে পাশের একটা সোনাঝুরি গাছের নীচে সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়লাম। মা আমার ডান পাশে বসে ছিল। দুজনের চোখ ছিল নদীর চিকমিকি বালির উপর। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মায়ের চোখ অশ্রুশূন্য থাকলেও মনের অন্তরে বেদনাভাব স্পষ্ট অনুভব করছিলাম। তাতে আমার মন ব্যথিত হচ্ছিলো। আমি ডান হাত বাড়িয়ে তাঁর ডান বাহু জড়িয়ে আমার কাঁধের কাছে টেনে নিলাম। এখানকার নীরবতা কিছু একটা যেন বলছিল। মায়ের একমনা হয়ে বসে থাকা দেখে প্রশ্ন করলাম, “এই ভাবে চুপ করে কী ভাবছো মামণি?” মা মুখ নামিয়ে বলল, “পাখীর ডাক শুনছি বাবু”। আমি আশ্চর্য হলাম। মনে মনে হাসলাম, “পাখীর ডাক শুনছো মানে?” মা বলল, “হ্যাঁ । তুইও শোন দ্যাখ ভালো লাগবে”। এই মুহূর্তে মায়ের মন ঠিক রাখার জন্য আমি সবকিছুই করতে রাজি।তাই মায়ের কথা মতো আমিও পাখীর ডাকের দিকে মনোযোগ দিলাম। মা জিজ্ঞেস করলো, “শুনছিস বাবু?” আমি বললাম, “হ্যাঁ মা। শুনছি”। “কতগুলো পাখীর ডাক শুনতে পাচ্ছিস বলতো?” আমি মনোযোগ দিয়ে শুনে বললাম, “দুই রকম! দুই রকম পাখীর ডাক শুনতে পাচ্ছি মা”। মা হাসল। মায়ের মুখে হাসির ঝলক দেখে আমারও মন উছলে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম, “হাসলে কেন মা?” মা বলল, “আরও ভালো করে মন দিয়ে শোন, দিয়ে আমায় বল কয়টা পাখী?” তাঁর কথা মতো আমিও তাই করলাম। বাতাসে ভেসে আসা কিচিরমিচির শব্দ গুলোকে বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। হ্যাঁ খুব সম্ভবত আরও একটা নতুন পাখীর ডাক শুনতে পেলাম। তারমানে মোট তিনটে। মাকে বললাম, “তিন রকমের পাখীর ডাক শুনতে পেলাম মা”। মা আবার হেসে বলল, “চার রকমের। চার ধরণের পাখী রয়েছে আমাদের চারপাশে”। আমি অবাক হলাম, “ওমা সত্যি! কিন্তু আমি তো তিনটেই শুনতে পাচ্ছি মা”। মা আবার হেসে বলল, “ওই পাখী কলকাতার পরিবেশে থাকেনা বলে তার ডাক কোনোদিন শুনিসনি। তাই কানে ধরছে না”। আমি হাসলাম। যাইহোক মাকে স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনতে আমি ব্যর্থ হলেও পাখীরা তা করে দেওয়াতে একপ্রকার খুশিই হলাম। ভালো লাগছিলো পাখীর কলরবে এই জায়গাটা উপভোগ করতে। শীতল বাতাসের অবিরাম প্রবাহে সোনাঝুরি গাছের হলুদ ফুল ঝিরঝির করে খসে পড়ল আমাদের চোখের সামনে। “দ্যাখো মা সোনাঝুরি গাছের ফুল গুলো ঝরে কেমন হাওয়ার সঙ্গে বাতাসে মিশে যাচ্ছে”। আমি আঙুল দিয়ে তা মাকে দেখাতে মা আবার বলে উঠল, “জানিস বাবু সোনাঝুরি গাছের নামকরণ কে করেছিলেন?” আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা আবার কেমন প্রশ্ন মা? কোন বস্তুর কোন বিশেষ ব্যক্তি নামকরণ করেন নাকি? এটা নাম তো প্রচলিত হয়ে আসছে তাই না?” মা আবার হালকা হাসল, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তিনিই এই গাছের নাম রেখেছিলেন সোনাঝুরি। যার ফুল সোনার মতো ঝরে পড়ে”। আমার খেয়াল হল, “হ্যাঁ সত্যিই তো। এই গাছের উজ্জ্বল হলুদাভ ফুলের রং কিছুটা সোনার মতোই”। আমি মায়ের দিকে চাইলাম, “ মা তুমি ঠিকই বলেছ। এখন আমি বুঝতে পারছি এই গাছের নামকরণের সার্থকতা”। মা শুধু, “হুম” বলে চুপ করে রইল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ আমরা নিরব রইলাম। মাও হাঁটু মুড়ি দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে ছিল। আমি স্তব্ধতা ভাঙলাম। “দ্যাখো মা, বাবা কেমন সকাল সকাল আমাকে না জানিয়েই কেটে পড়ল”। মা সামনের দিকে চোখ মেলে উত্তর দিলো, “ভালোই করেছে। এখন কয়েকদিন নিজের হাতেই রেঁধে খাক ব্যাটা!!” মায়ের মুখে বাবার সম্বন্ধে এমন উক্তি পেয়ে মনে মনে হাসলাম। বললাম, “আহা মা!এমন কেন বলছো গো?” মা বলল, “আর নয়তো কি? ওর জন্যই আমার বাবা মরেছে। ওর জন্যই আমি বাবাকে মরার আগে পর্যন্ত দেখতে পেলাম না”। আমি আবার হাসলাম, “বলো কি মা? মানে বাবার জন্য দাদাই মারা গেছেন? এটা কেমন যুক্তি তোমার?” কড়া গলায় মা বলল, “হ্যাঁ সব কিছুর জন্য ও দায়ী”। আমি অবাক হলাম, “বলো কি মা? সব কিছুর জন্য বাবা দায়ী?” মা জোর গলায় বলল, “ হ্যাঁ ওই দায়ী”। আমি হাসি ধরে রাখতে পারলাম না, “মানে এই পৃথিবীতে যা খারাপ কিছু ঘটছে সব? মা?” “হ্যাঁ সব! আমার জীবনের প্রত্যেকটা খারাপ ঘটনার পর তোর বাবার আবির্ভাব হয়”। সত্যি এবার আমার পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। মনে হচ্ছে উল্টো দিকে ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে হো হো করে হাসি। কিন্তু মায়ের নজরে তা অশোভনীয় দেখাবে বলে নিজেকে সংযত করে রাখলাম। বললাম, “মা, বাবা কিন্তু তোমায় ভীষণ ভালোবাসেন। গতকাল বাবা তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন”। আমার কথা শুনে মা একটু অস্বস্তি অনুভব করলো। ঠোঁটের কোণে তাঁর আবছা হাসিও লক্ষ্য করলাম। যদিও ক্ষণিকের মধ্যেই সেই হাসি বিলীন হয়ে পুনরায় গম্ভীর রূপ ফিরে এলো। “তুই কখন দেখলি রে?” আশ্চর্যান্বিত অভিব্যক্তি মায়ের। “ওই তো গতকাল বিকেল বেলা সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়”। “হুম” আবারও একটা গম্ভীর প্রতিক্রিয়া। “তাহলে তুমি কি বলতে চাইছো মা? এটা কি ভালোবাসা নয়? আপন জনের জন্যই তো কাঁদে মানুষ তাই না মা…?” মায়ের মুখে হুঙ্কার ধ্বনি, “ও’টা সে নিজের দুঃখে কেঁদেছে ব্যাটার ছেলে! জানে এই কয়দিন নিজের হাতে রেঁধে খেতে হবে। তাই সে কেঁদেছে”! আমি হাসলাম, “হ্যাঁ মা সেতো নিশ্চয়ই। এবার তিনি নিজের হাতে রাঁধবেন, বাড়বেন এবং খাবেনও। কি বলো মা?” মা আবার গম্ভীর গলায়, “হুম” বলে চুপ করে রইল।
Parent